চেতনার জাগরণ? নাকি সমালোচনার জবাব? (শ্রীল সচ্চীদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় কি নিত্যসিদ্ধ ভগবৎ পার্ষদ অথবা সাধন সিদ্ধ?) — পর্ব্ব- ২
- The Symbol of Faith
- Jul 9
- 4 min read
Updated: Jul 14
প্রকাশনা তিথি : মঙ্গলবার (প্রদ্য়ুম্ন), ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রীধর ৫৩৯ গৌরাব্দ

শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গৌ জয়তঃ
চেতনার জাগরণ? নাকি সমালোচনার জবাব?
(শ্রীল সচ্চীদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় কি নিত্যসিদ্ধ ভগবৎ পার্ষদ অথবা সাধন সিদ্ধ?) —পর্ব্ব-২
প্রবন্ধকর্ত্তা : শ্রীশ্রীল শ্যাম দাস বাবা মহারাজ
বিঃ দ্রঃ পুর্ব্ব সংখ্যায় যথাসম্ভব শ্রীগুরু-গৌড়ীয়ের অসমোর্দ্ধ বিচার প্রকাশ করা হয়েছিল। বর্ত্তমান বিচারগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখবেন — এই স্বনির্ব্বন্ধ অনুরোধ রাখি।
সাক্ষাৎ ভগবৎ-পার্ষদ তথা ভগবৎ-অবতার শঙ্কর, ভগবানের আদেশে ভয়ংকর মায়াবাদ ভাষ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, কোন ভক্ত কি তা মেনে নিতে রাজি হবেন? গরুড় ভগবান নিত্য-ভগবৎ-পার্ষদ হয়েও কেন সর্প-মৎস্যাদি শিকার করেন? ভগবৎ-পার্ষদ ভীমসেন কেন দুঃশাসনের বক্ষস্থল বিদীর্ণপূর্ব্বক তা’র রক্তপানের কথা বলেন এবং ঐ রক্ত দিয়ে দ্রৌপদীর এতদিনের উন্মুক্ত কেশবন্ধনের প্রতিশ্রুতি কেন দেন এতে কি তাঁর বৈষ্ণবতা থাকে? বদ্ধজীবের হৃদয় ঐরূপ নানা প্রকার সংশয়-সন্দেহের ঝঞ্ঝাভাতে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, কোন প্রকার আশার আলোক না দেখে হতাশায় বা নিরাশায় ডুবে যায়।
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদ বলেন যে,—
"অনন্যা ভক্তি আশ্রিত সিদ্ধপুরুষে (নিত্যসিদ্ধ বা সাধনসিদ্ধ) কোন দুরাচার নাই; অজ্ঞ লোকের দৃষ্টিতে দুরাচার বলে দৃষ্ট হলেও তা প্রকৃত দুরাচার নয়, তিনি প্রকৃতই সাধু। অজ্ঞের কথা দূরে থাকুক, “বৈষ্ণবের ক্রীয়া মুদ্রা বিজ্ঞে না বোঝায়।"
উত্তমাধিকারী ব্যক্তির আচরণ অক্ষজ জ্ঞানের বিচার্য্য নয়। শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেন যে,—
শুন বিপ্র মহা-অধিকারী যেবা হয়,
তবে তান দোষ-গুণ কিছু না জন্মায়॥ (চৈঃ ভাঃ অন্ত্য ৬|২৬)
স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিঁনি ঐ একই উপদেশ দেন, উদ্ধব জী মহারাজ কে, যথা—
ন ময্যেকান্তভক্তানাং গুণদোষোদ্ভবা গুণাঃ।
সাধুনাং সমচিত্তানাং বুদ্ধেঃ পরমুপেয়ুষাম্ ॥ (ভাঃ ১১|২০|৩৬)
অর্থাৎ রাগাদি-রহিত, সর্ব্বত্র সমবুদ্ধিসম্পন্ন এবং বুদ্ধির অতীত ভগবদ্বস্তু-প্রাপ্ত মদীয় একান্তভক্তগণের বিহিত বা নিষিদ্ধ কর্ম্মজন্য পুণ্য বা পাপের সম্ভব হয় না।
তবে মহাতের আচরণ, অধিকারীজন ব্যতীত অন্যের অনুকরণীয় নয়।
অধিকারী বই করে তাহার আচার।
দুঃখ পায় সেই জন, পাপ জন্মে তার॥
রুদ্র বিনে অন্যে যদি করে বিষ পান।
সর্ব্বথায় মরে সর্ব্ব পুরাণ প্রমাণ॥ (চৈঃ ভাঃ অন্ত্য ৬|৩০-৩১)
এ সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীশুকদেব জী মহারাজ বলেন যে,—
“তেজীয়সাং ন দোষায় বহ্নে সর্ব্ভুজো যথা॥” (ভাঃ ১০|৩৩|২৯)
অর্থাৎ, অগ্নির সর্ব্বভুকত্বের ন্যায়, সমর্থবান্ তেজস্বী পুরুষদিগেরও কোনরূপ ধৰ্ম্ম-মর্য্যাদা লঙ্ঘ্যন ও স্ত্রীসন্দর্শনাদি দৃষ্ট হইলে উহা দূষণীয় নহে।
অকৃত্রিম মহতের বাহ্যদুরাচার দর্শনে, আধ্যক্ষিক-বিচার পরায়ণ ব্যক্তির কটাক্ষ তার নিজ বিনাশেরই কারণ।
শ্রীচৈতন্য ভাগবতে দেখা যায়,—
"এতেকে যে না জানিঞা নিন্দে তান কৰ্ম্ম।
নিজ-দোষে সেই দুঃখ পায় জন্ম জন্ম॥
গর্হিত করয়ে যদি মহা-অধিকারী।
নিন্দার কি দায়, তাঁরে হাসিলেই মরি॥ (চৈঃ ভাঃ অন্ত্য ৬|৩৪-৩৫)
শ্রীমন্নিত্যানন্দ সম্বন্ধে শ্রীমন্মহাপ্রভু এই বলে সতর্ক করেন যে,—
“মদিরা যবনী যদি নিত্যানন্দ ধরে।
তথাপি ব্রহ্মার বন্দ্য কহিল তোমারে॥” (চৈঃ ভাঃ অন্ত্য ৬|১২৩)
শ্রীমদ্ভাগবত প্রমাণে দেখা যায় যে,— শ্রীগরুড় ভগবানের মৎস্য তথা সর্প সংগ্রহরূপ বাহ্য দোষ বিদ্যমান। সৌভরী ঋষি শ্রীগরুড় ভগবান কে শাপ দিয়ে নিজেই ৬০ হাজার বছর যাবত কৃত তপস্যার ফল নষ্ট করে ভীষণ মায়াতে পতিত হন।
শ্রীমদ্ভাগবত প্রমাণে দেখা যায় যে,— বৈশিষ্ট্য মুনিকে নরমাংস দেওয়া হয়েছিল। কল্মষপাদের রাক্ষস ভাবে বিভাবিত অবস্থায় নরমাংস ভক্ষণের কথা পাওয়া যায়– অভিশাপের ফলে। কেন শ্রীক্ষেত্রের প্রভাবে মৎস্য আহারের ফল– হবিষান্ন আহার হয়*?
কেন স্বর্গরাজ ইন্দ্র মহারাজ, গৌতম ঋষির পত্নী অহল্যার সঙ্গ করে অভিশাপ স্বরূপে সহস্র যোনি নিজ দেহে ডেকে আনেন? কেন দেবগুরু বৃহস্পতি ভ্রাতৃ-বধুর সঙ্গ করেন? কেন চন্দ্রদেব গুরুপত্নী– তারার সঙ্গ করেন? — ইত্যাদি অজস্র প্রশ্নবানে জর্জ্জরিত অবস্থায় ভগবৎ প্রাপ্তি অসম্ভব। শ্রীল প্রভুপাদ প্রয়সঃ বলতেন যে,— “Logical interpretation cannot stand in the way of that Absolute Truth.”
চলিত সমাজে শুনা যায় যে,— একলব্যের প্রতি দ্রোণাচার্য্যের অবিচার আদৌ যুক্তি-সঙ্গঁত নয়।— ইত্যাদি জাগতিক বিচার যে কতটা অবৈধ– তা পূর্ব্বে সময়ে সময়ে বহুবার উত্তর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বর্ত্তমান প্রসঙ্গঁ এতটাই ভয়ঙ্কর কর্ক্কট-রোগে আক্রান্ত যে,– শাস্ত্রীয় সুবিচার আদৌ সেক্ষেত্রে প্রবেশ পত্র পাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমাদের সম্মুখে আজ প্রশ্ন এই যে—শ্রীল সচ্চীদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নিত্য সিদ্ধ ভগবৎ পার্ষদ, অথবা তিনি সাধন সিদ্ধ এক ভক্ত? এই প্রশ্নবান প্রমাণ করে দেয় যে আমরা কতদূর লক্ষ্যভ্রষ্ট ও পতিত হয়ে গিয়েছি। ম্লেচ্ছ-কুলে জন্ম গ্রহণ করে শ্রীল হরিদাস ঠাকুর কি নিত্যসিদ্ধ ভগবৎ-পার্ষদ, অথবা সাধন সিদ্ধ এক ভক্ত? — এরূপ প্রশ্নও আমাদের মনে জাগে। এ সকল যাবতীয় প্রশ্নের সৎ-সিদ্ধান্তসুলভ উত্তর আছে, কিন্তু যদি পরিপ্রশ্ন না হয়ে, ওই সকল প্রশ্নবান কেবলই challenging mood পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে হিতে বিপরীত ফল প্রসব করে, যথা—
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশযাত্মা বিনশ্যতি৷
নাযং লোকোস্তি ন পরো ন সুখং সংশযাত্মনঃ॥ (গীতা ৪|৪০)
অজ্ঞ, অশ্রদ্ধালু এবং সংশয়াত্মা— এই তিনশ্রেণীর ব্যক্তি মহামঙ্গলরূপ বিনাশ আবাহন করিয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে সংশয়াত্মার ইহলোক পরলোক কিংবা সুখ কিছুই লাভ হয় না।
প্রথম কথা এই যে,— যদি শ্রীল সচ্চীদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নিত্যসিদ্ধ ভগবৎ-পার্ষদ না হতেন তবে প্রথম থেকেই দীক্ষাদি বাহ্য অপেক্ষা ছাড়াই, অপ্রাকৃত জগতের গুহ্যাতিগুহ্য রহস্যময় শাস্ত্রীয় বিচারগুলো বিভিন্ন গ্রন্থাদীর (‘আদি’ অর্থে অসংখ্য লেখনি-আদি) মাধ্যমে কিভাবে হৃদয় থেকে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন? যদি লৌকিক বিচারে সে সবকিছু কেবলমাত্র প্রতিভা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় তবে সেক্ষেত্রে ঘোরতর আপত্তি আসতে বাধ্য, কারণ প্রতিভা ও ভক্তিবল আদৌ এক বস্তু নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। প্রতিভার ক্ষেত্রে পূর্ব সংস্কারের ভিত্তিতে নিজ বল ভরসার অপেক্ষা আছে যথেষ্ট, কিন্তু ভক্তিরাজ্যের মূল কথা— “নিজ চেষ্টা বল প্রতি ভরসা ছাড়িয়া, তোমার ইচ্ছায় আছি নির্ভর করিয়া।” — এইভাব। কখনবা গুরু-বৈষ্ণবগণ কদাচিৎ কোন জাগতিক যোগ্যজনের প্রতিভা কে ভক্তিরাজ্যে সেবায় লাগিয়ে দিয়ে তার পরম মঙ্গল করে দেন, কিন্তু প্রতিভা একলা কোনভাবেই ভক্তিরাজ্যে প্রবেশ অধিকারই পায় না, দৃষ্টান্ত স্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ইত্যাদি অসংখ্য নাম দেওয়া যায়। ময়দানবের কারিগরী দক্ষতা বা বিচক্ষণতা স্বর্গরাজ্যের বিশ্বকর্ম্মা জীর থেকে বহুগুণ বেশি বটে বা দেবগুরু বৃহস্পতির তুলনায় অসুরকূলের গুরু শুক্রাচার্য্যের যোগ্যতা জাগতিক বিচারে অধিক ছিল, ফলে নিজ পুত্র কচকে মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যা আয়ত্ব করতে তিঁনি তাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে বিচার্য্য় বিষয় এই যে,– ময়দানবের যোগ্যতারূপ প্রতিভা যখন ভক্তগণের সেবায় অর্থাৎ পঞ্চপান্ডবগণের সেবায় ইন্দ্রপ্রস্থের অভিনব প্রাসাদ-নির্ম্মাণ কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন তা’র পরম-মঙ্গলরূপ ভক্তিপদ প্রাপ্ত হয়েছিল।
(ধারাবাহিকভাবে ক্রমশঃ প্রকাশ্য)
Comments