মানবজীবনের সার্থকতা কোথায়? (পর্ব্ব- ১)
- The Symbol of Faith
- Aug 3, 2024
- 3 min read
মানবজীবনের সার্থকতা কোথায়? (পর্ব্ব- ১)
— ত্রিডন্ডীস্বামী শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি কুমুদ সন্ত গোস্বামী মহারাজ
বহু বহু জন্ম-জন্মান্তরের পর এই সুদুর্লভ মনুষ্য-জন্ম লাভ হয়। "এই সুদুর্লভ মনুষ্যজন্মের সার্থকতা কোথায়?” তাহা মনুষ্যমাত্রেরই বিবেচনা করা একান্ত কর্ত্তব্য। এই ভবাটবীতে আগমন করতঃ বিমুখিনী মায়াকর্ত্তৃক আলিঙ্গিত হইয়া জীব মায়িক বস্তুর সেবায় আত্মবলিদানপূর্ব্বক তদ্বিষয়ে কর্ত্তব্য- সাধন-তৎপরতাকেই মনুষ্য জীবনের একমাত্র সার্থকতা বলিয়া মনে করে এবং তদনুরূপ কার্য্য করিতে করিতে কালের স্রোতে ভাসিতে থাকে।
মায়াদেবীর বিচিত্রতাপূর্ণ রাজত্বে নয়ন ও মনোমুগ্ধকর বস্তুর বিচিত্রতা দর্শন করিয়া নিত্য নবনবায়মান ভোগ করিবার স্পৃহা বদ্ধজীবের হৃদয়-অন্তঃপুরে গুপ্তভাবে লুক্কায়িত থাকিয়া তাহার ঐপ্রকার ভোগস্পৃহা চরিতার্থ করাকেই মনুষ্যজীবনের সার্থকতা বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহে। ঐপ্রকার ভোগরূপ বঞ্চককে পরমাত্মীয়বোধে তাহার মধুপুষ্পিত বাক্যগুলিই অর্থাৎ তাহার বঞ্চনাময়ী প্রেরণাগুলি একমাত্র পালনীয় মনে করিয়া "কর্ত্তাহমিতি মন্যতে”এই বিচারে মনুষ্য যে-কোন কার্য্য করিতে যায়, তাহাতে মনুষ্যজীবনের কর্ত্তব্যসাধনের
পরিবর্তে মূলে আভ্যন্তরিক ভোগ-স্পৃহাই থাকিয়া যায়
। তখন দেহসম্বন্ধীয় স্ত্রী,পুত্র ও আত্মীয়স্বজনের ভরণ-পোষণাদি মাত্র মনুষ্যজীবনের সার্থকতারূপে
প্রতিপন্ন হয়। এই প্রতিপন্ন বিষয় সুচারুরূপে পালনের নিমিত্ত মনুষ্য তখন ঊর্দ্ধনিঃশ্বাসে দৌড়িতে-দৌড়িতে মায়ার দ্বারে অতিথি হইয়া দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, এবং আর্ত্তনাদের সহিত ডাকিতে থাকে-কে আছ, শীঘ্র দরজা খোল,আমি বিপন্ন। তখন মায়াদেবী মোহিনীমূর্ত্তিতে তাহার নিকটস্থ হইয়া বলিতে থাকেন,-"কে তুমি, তোমার প্রয়োজন কি? কি জন্য তুমি এখানে আগমন করিয়াছ?” তাহার উত্তরে ঐ জীব বলিতে থাকে, আমি অর্থের প্রয়াসী হইয়া তোমার দ্বারস্থ হইয়াছি। তুমি আমার প্রতি সদয় হইয়া আমাকে কিছু অর্থ প্রদান কর। কেননা, আমি ঐ অর্থের দ্বারা স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়-স্বজনের সেবা করিয়া আমার এই মনুষ্য জীবনের সার্থকতা করিব। মায়াদেবী তখন তাহার উত্তরে বলিতে থাকেন, তুমি যদি কনকের প্রয়াসী হও, তাহা হইলে তোমাকে নিজ স্বাতন্ত্র্য ছাড়িয়া আমার নিকট আসিতে হইবে, অর্থাৎ তোমার নিজের নিজত্বকে বলিদান করিয়া আমি যখন যাহা আদেশ করিব, সেই মুহূর্ত্তে তাহা অবনত মস্তকে পালন করিয়া আমার চিরকৃতদাস থাকিতে হইবে-এই সর্ত্তে প্রস্তুত থাকিলে কনক পাইতে পারিবে। তাহাও সুদুর্লভ। তখন সেই জীব কাতর-স্বরে করজোড়ে নিবেদন করিতে থাকে,-"আপনি যখন যাহা আদেশ করিবেন, তাহা আমি অবনতমস্তকে পালন করিব।। ইহাতে আমার
বিন্দুমাত্রও ত্রুটী হইবে না।"
কিন্তু হায়! দুদ্দৈবের ফের এমনই যে, ঐ জীব বিষয়-মোহ-মদিরায় প্রমত্ত হইয়া স্ব-স্বরূপের শুদ্ধদাসত্বের কথা বিস্মৃত হইয়া ধূর্তা, কপটী, ছদ্মবেশী-করাল- বদনী মায়ার কর্কশ বাক্যগুলিও অতি আদরের বলিয়া মনে করিল; অমনি সে মায়ার দাসত্বের ডোরে চিরতরে বন্দী হইয়া কনকভোগকেই জীবনের ব্রত করিয়া বসিল-কনক-কামিনী যে বাঘিনী-স্বরূপ, তাহা তাহার বোধগম্য হইল না। ঐ অর্থ তখন তাহার জীবনকে অনর্থে বিজড়িত করিয়া জন্ম- জন্মান্তরের ঘূর্ণিপাকে ফেলিয়া দিয়া পরম বা শ্রেষ্ঠ প্রয়োজন যাহা, তাহা হইতে শতকোটী যোজন দূরে অবস্থান করাইল। বস্তুতঃ পক্ষে জড় অর্থের প্রয়াস ত্যাগ করিয়া পরমার্থ অর্জ্জনের স্পৃহা জাগিলে নিত্যমঙ্গল বা শ্রেষ্ঠ প্রয়োজন লাভ হইতে পারে।
কেহ কেহ ঐ প্রকার বিচারকে বহুমানন না করিয়া কৰ্ম্মমার্গে নিজের জীবন উৎসর্গ করাকেই জীবনের যথাযথ কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করেন। কিন্তু কর্ম্মের নাগরদোলায় আরোহণ করতঃ জগতে কর্মবীর সাজিবার অভিলাষই কি মানব- জীবনের সার্থকতা?
"তাবৎ কর্মাণি কুব্বীত ন নির্বিদ্যেত যাবতা।
মৎকথাশ্রবণাদৌ বা শ্রদ্ধা যাবন্ন জায়তে।।
(ভাঃ ১১/২০/৯)
অর্থাৎ যে-কাল পর্যন্ত্য কৰ্ম্মফলভোগে বিরক্তি না হয় অথবা ভগবৎকথা- শ্রবণে শ্রদ্ধা বিন্দুমাত্রও না জন্মে তৎকাল পর্যন্ত কৰ্ম্মসকলেরই অনুষ্ঠান করিবে। কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত কর্ত্তব্য সাধনের জন্য অর্থাৎ মানব-জীবনের সার্থকতা সম্পাদনে ব্রতী হইয়াছেন, তাঁহারা ঐ প্রকার দৈহিক বা মানসিক সেবাকে চরম প্রয়োজন বিবেচনা করিবেন না। কেন না, এই যে পঞ্চভূতাত্মক দেহ, ইহা অনিত্য, কুকুর-শৃগালের ভক্ষ্য এবং এই মন সংকল্প-বিকল্পাত্মক; "এই ভাল এই মন্দ, সব মনোধৰ্ম্ম”- মন যে-বিচারটাকে এক মিনিটের পূর্ব্বে অতি উত্তম বলিয়া গ্রহণ করে, আবার পর মুহূর্তে তাহা চুরমার করিয়া ভাঙ্গিয়া দেয়। যাঁহারা নিজ নিজ জীবনের সার্থকতা সত্য করিতে চাহেন, তাঁহারা একবার সরল অন্তঃকরণে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের এই বাক্যটা বিচার করিবেন।
"ভারতভূমিতে হৈল মনুষ্যজন্ম যার।
জন্ম সার্থক করি' কর পর উপকার।।”
(চৈঃ চঃ আঃ ৯/৪১)
শ্রীমন্মহাপ্রভু পরের উপকার করিতে বলিয়াছেন; কিন্তু সে উপকারের মুখ্য তাৎপর্য্য কি, তাহা মনুষ্যমাত্রেরই বিচার করা কর্ত্তব্য,-
"চৈতন্যচন্দ্রের দয়া করহ বিচার।
বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার।।"
চৌরাশীলক্ষ যোনি ভ্রমণ করিবার পর এই ভারতভূমিতে জন্মলাভ পরম সৌভাগ্যের বিষয় কেন না, এই ভারতভূমি তপোবন, এইখানে যত মুনি, ঋষি জন্মগ্রহণ করিয়া আরাধনার দ্বারা শ্রীভগবদর্শন লাভ করিয়াছেন এবং শ্রীভগবানও
"পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধৰ্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।”
(গীতা ৪/৮)
-এই বাক্য সফল করিবার জন্য যুগে যুগে নানা অবতাররূপে মাদৃশ পতিত জীবকে উদ্ধারের জন্য সাঙ্গোপাঙ্গ ও ধাম সহ এই তপঃক্ষেত্র বা ধৰ্ম্মক্ষেত্র ভারতবর্ষেই আবির্ভূত হইয়াছেন, হইতেছেন ও হইবেন। এবং বিষ্ণুপাদোদক গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী প্রভৃতি যাবতীয় পূতা স্রোতস্বতী প্রবাহিত হইয়া ভারতবর্ষকে সর্ব্বদা পবিত্র করিয়া জীবের পাপ নাশ করতঃ শ্রীভগবানের পাদপদ্মে রতি উৎপন্ন করাইতেছেন। সুতরাং আমরা যাহারা এই প্রকার ধর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে জন্মলাভ করিয়াছি তাহাদের পরম উপকার করা স্বাভাবিক বৃত্তি, তাহাতে আর সন্দেহ কি?
— ক্রমশঃ















Comments