যেদিকে বাতাস
- The Symbol of Faith
- Aug 17, 2024
- 4 min read
যেদিকে বাতাস
—পরমহংস জগদগুরু শ্রীশ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর
বায়ুর অনুকূলে গমন করিলে আমরা জগতে লোকপ্রিয় হইতে পারি। আবার, লোকপ্রিয় হইবার জন্য আমরা অনেক সময় নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি না করিয়া তাহার বিপরীত ফল লাভ করি বা কার্য্যের ক্ষতি করিয়া বসি।
এক রাজা, তাঁহার প্রত্যেক কথায় “আজ্ঞে হ্যাঁ” করিতে পারে, এরূপ কয়েকটা তোষামুদের সঙ্গে কালযাপন করিতেন। তোষামুদের মধ্যে কুলগুরু, কুলপুরোহিত, চিকিৎসক, প্রিয় বন্ধুবর্গ ও ভূতক্-পাঠকপ্রমুখ অনেকগুলি মুখাপেক্ষী ছিলেন। এই মুখাপেক্ষিশ্রেণীর মধ্যে প্রবলভাবে প্রতিযোগিতা চলিতে থাকায় যে যত রাজার রুচির অনুকূলে নিজের নিজত্ব নষ্ট করিয়া ক্রিয়া-কলাপ ও বাক্যাদি প্রয়োগ করিতে পারিতেন, তাঁহাকেই রাজা অন্যের অপেক্ষা ভালবাসিতেন। ভালবাসা পাইবার জন্য রাজার প্রত্যেক চাকরই, পরস্পরের তোষামোদের কৌশল ছাপাইয়া অধিকতর প্রিয় হইবার যত্ন করিতেন। একদিন রাজা বলিলেন,-বেগুন খাইলে মুখে লাগে। তখনই একজন তোষামুদে বলিয়া উঠিলেন,-বেগুন নিতান্ত অখাদ্য, বুনো ওল কচু অপেক্ষাও মুখ লাগে। রাজা তাহার বাক্যে সন্তোষ প্রকাশ করিলেন; কিন্তু মনে মনে বুঝিলেন, তোষামুদের কথাটা ঠিক নহে। পরক্ষণেই রাজা বলিলেন,-বেগুন খাইতে ভাল লাগে, খাইবার কালে চিবাইতে হয় না ও সকল তরকারীর মধ্যে বেগুন ব্যবহার চলে। তাই শুনিয়া সেই তোষামুদে বলিলেন, লাফা, বেগুণের তুল্য কোন বস্তু নাই, উহা অনুপম। রাজা তাহাতেও সন্তোষ প্রকাশ করিলেন। অপর সময় এক ব্যক্তি রাজার সম্মুখে কতকগুলি ভাল কলা আনিয়া উপহার দিলেন। তদুত্তরে রাজা বলিলেন, কলা খাইলে সর্দি হয়। তাহাতে তোষামুদে বলিলেন, কলা খাইতে কখনও ভাল লাগে না, অধিকন্তু উহা নানা ব্যাধির কারণ।
পরক্ষণেই রাজা বলিলেন, তবে কলা খাইতে নেহাৎ মন্দ নহে। তোষামুদে তাহা শুনিয়া বলিলেন, কলার তুল্য আর উৎকৃষ্ট ফল নাই, বিশেষতঃ সন্ত্রী কলা অতি উপাদেয় বস্তু, যেমন খাইতে ভাল লাগে, তেমনই উপকারী। এইবারে রাজা তোষামুদেকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি দেখিতেছি আমার সকল কথারই অনুমোদন কর, ভাল হউক্, আর মন্দ হউক বিচার না করিয়া আমার বাক্যের অনুকূলে কথা বলায় আমি তাৎকালিক সন্তুষ্ট হই বটে, কিন্তু কোন উপকার পাই না। তোষামুদে তদুত্তরে বলিলেন, "হুজুর, আমি বেগুনেরও চাকর নই, কলাও চাকর নই, আমি হুজুরের চাকর। চাকর বা ভূতকের ধৰ্ম্মমাত্র পালন করি। আপনার প্রিয়বাক্য না বলিলে, আপনি ত' আমাকে চাকুরীতে রাখিবেন না; সুতরাং উদরের জন্য, আপনার প্রিয় হইবার, আপনার প্রয়োজন না থাকিলেও আমার প্রয়োজন আছে।" এই কথা জানিয়া রাজার অন্যান্য কর্মচারী সেই নীতি অবলম্বন করিলেন। কুলগুরু রাজপ্রিয় হইবার জন্য তিনি যাহা চান, সেই দেবতার মন্ত্র দিলেন। কুলপুরোহিত যজমানের প্রিয় হইবার জন্য যাবতীয় অনুষ্ঠান সঙ্কোচ করিয়া দিলেন। ভূতক পাঠক ইন্দ্রিয়তর্পণ বিষয়ক কৃষ্ণ-লীলা পাঠ ও গান করিয়া শ্রবণকারীর জড়েন্দ্রিয়তর্পণ স্পৃহা দিন দিন বাড়াইয়া দিলেন। সকলেই অন্নদাতার প্রেমভাজন হইলেন, কিন্তু তাদৃশ অনুষ্ঠানের পরিণাম বিষময় হইল।
বিদ্যাসাগর মহাশয়, 'বর্ণ-পরিচয়ে' মাসীর কান কামড়ানোর গল্প লিখিয়াছেন। মাসী স্ব-পুত্রের প্রিয় হইবার জন্য তাহার চিত্তবৃত্তির অনুকূলে পবন ব্যজন করায় প্রীতিভাক্ হইয়াছিলেন; কিন্তু পরিণাম বিষময় হইল।
চিকিৎসক যদি রোগীর প্রিয় হইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তাহার কুপথ্যের ব্যবস্থা করেন। উপদেশক যদি শ্রোতৃবর্গের ইন্দ্রিয়-তর্পণের জন্য-তাহাদিগের কু-প্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য রুচির অনুকূলে বায়ু ব্যজন করেন, ভূতক্-পাঠক যদি অর্থের জন্য ধর্ম্মের নামে লাম্পট্টের ইন্দ্রিয়তর্পণমূলে শাস্ত্র-তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা
করেন, তাহা হইলে যে বিষময় ফল প্রসব করে, তাহা অবর্ণনীয়। আজকালকার দিনে ভাড়া লইয়া ভূতকগণ যে ধর্ম-বক্তৃতা ও ভাগবত পাঠ করিয়া থাকেন, তাহা সত্য বিসর্জন দিয়া ঐহিক কাম সংগ্রহোদ্দেশ্যমূলক চেষ্টা মাত্রে পরিণত হয়। নিজের দগ্ধ উদরের জন্য, কপর্দক লাভের আশায় লোকরঞ্জন মূলে যে পাঠ- কীর্ত্তনাদি হইতেছে, তন্দ্বারা পাঠক ও কীর্ত্তনীয়ার অভীষ্ট সিদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তাহা বিকৃতভাবাপন্ন শ্রোতৃবর্গের অমঙ্গল উৎপন্ন করে। বালক যেমন অগ্নি ক্রীড়ার বিষময় ফল জানে না, যুবক যেমন ইন্দ্রিয়-তৎপরতার আতিশয্যজনিত বিষময় ফলের গ্রাহ্য করে না, বৃদ্ধ যেমন স্বীয় জীবিতোত্তর কালে চিত্তোৎকর্ষে উদাসীন হইয়া চর্বিত চর্ব্বর্ণরূপ ভোগপর চিন্তানলে দগ্ধ হয়, মুর্খ যেরূপ নিজ অজ্ঞানকে জ্ঞান বলিয়া ভ্রম করিতে গিয়া বহু জনপ্রিয়তার আবাহন করে, এবং তাহার বিষময় ফলে নির্বোধাখ্যা প্রাপ্ত হয়, সেইরূপ প্রতিষ্ঠাশা প্রিয় বক্তা, পাঠক, উপদেশক এবং চিকিৎসকগণও নিজ নিজ চেষ্টাদ্বারা আপনাদিগকে ও তাঁহাদের স্ব-স্ব যজমানবর্গকে বিপন্ন করেন।
প্রতিষ্ঠাশাপ্রিয়তা সকল কল্যাণের বিঘ্নকারক। গণপতির উপাসনা করিলে জীব বহু-স্তাবক বা গণ লাভ করেন। তাহা সত্ত্ব ও তমোগুণের সংমিশ্রণে উৎপত্তি লাভ করে। শ্রীনারায়ণের উপাসকগণ বিশুদ্ধ সত্ত্বের উপাসক এবং জীবের প্রতি দয়াবিশিষ্ট হইয়া জীবের গুণময়ী ধারণা হইতে জীবকে উত্তোলন করেন। অসুবিধার অনুকূলে বাতাস দিবার তাঁহাদের প্রবৃত্তি নাই। সেজন্য শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী লিখিয়াছেন,-
চৈতন্যচন্দ্রের দয়া করহ বিচার।
বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার।
ভারত-ভূমিতে হইল মনুষ্য জন্ম যা'র।
জন্ম সার্থক করি' কর পর উপকার।
যদি আমরা স্বার্থপর হইয়া সমাজের অমঙ্গল সাধন করি, তাহা হইলে সমাজ আমাদিগকে বিশেষ আদর করিবে, আর আমরাও তদ্বিনিময়ে সামাজিকগণকে নরকের পথে পাঠাইতে পারিব-এই বুদ্ধি দয়ার প্রকৃষ্ট পরিচয় নহে। উদ্ধত যুবককে ইন্দ্রিয়-তর্পণের সাহায্য করা, রোগীকে কুপথ্য প্রদান করা ও হরিবিমুখ সমাজের ভোগ বৃদ্ধি করিয়া ধ্বংসপথে প্রেরণ করা কখনই উচিত নহে। আমরা চিকিৎসক, ভূতক্-পাঠক, বক্তা ও উপদেশক-সূত্রে নিজ নিজ অমঙ্গল সাধন করিয়া হিংসাপ্রবৃত্তিমূলে পরদুঃখে সুখী হইবার প্রথা যেন বাড়াইতে না যাই। আপাতসুখে ব্যস্ত হইয়া ভব-রোগী, ভগবত-শ্রোতা ও শিষ্যাভিমানিগণ আপনাদিগকে তাঁহাদের চিকিৎসকের, ভূতক-পাঠকের ও বক্তার দয়ার পাত্র জানিয়া পরিশেষে বঞ্চিত না হন, তদ্বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি রাখা কি উচিত নহে? রোগী চিকিৎসা প্রণালীর নিন্দাবাদ (করিতে পারেন, ভোগের ব্যাঘাত হইলে 'ভাগবত-শ্রোতা ভূতক্-পাঠককে বরখাস্ত করিতে পারেন জানিয়াও রোগী, শিষ্য বা শ্রোতাকে আপাতমধুর বাক্যে ভুলাইয়া অনিষ্ট সাধন করা উচিত নহে। বাতাস যেদিকে বহিতেছে, তাহার অনুগমন করিলে সকল স্থানে ফল ভাল হয় না।
শ্রীমদ্ভাগবত বাস্তবজ্ঞানের কথাই বলিয়াছেন, নির্মৎসর সাধুর ধর্মই বলিয়াছেন। আমাদের পিত্তোপতপ্ত রসনার পক্ষে তাহা আপাতমধুর না হওয়ায় আমরা যেন ভাগবত-বিরোধীকে ভাল খোশামুদে ভাগবত পাঠকের স্থলে নিযুক্ত না করি। শিক্ষক শাসনদ্বারা বালকের মঙ্গল বিধান করেন। শাসন স্বীকার করা ছাত্রের প্রথমে ক্লেশকর হইলেও শিক্ষক হনন করা উচিত নহে। ডাক্তারকে প্রহার করা ঠিক নয় বা প্রকৃত নিৰ্ম্মৎসরকে নিন্দা করা ঠিক নহে। জীব স্বভাববশতঃ নিজ বুদ্ধির অপব্যবহার-ক্রমেই অসুবিধার মধ্যে পড়িয়াছেন, একথা আমরা অনেক সময় ভুলিয়া গিয়া মহতের চরণে অপরাধ করিয়া বসি। আবার, বাতাস সত্যের অনুকূল হইলে বাস্তবিক সুফল উৎপন্ন হয়। শ্রীগৌরহরির প্রকটকালের কথা শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতী ত্রিদণ্ডিপাদ যাহা বলিয়াছেন, আমরা সেই বাক্যই পুনরায় বলিতেছি,-
দন্তে নিধায় তৃণকং পদয়োর্নিপত্য
কৃত্বা চ কাকুশতমেতদহং ব্রবীমি।
হে সাধবঃ সকলমেব বিহায় দূরাৎ
চৈতন্যচন্দ্রচরণে কুরুতানুরাগম্।।
যেহেতু গৌরহরির প্রকটকালে সেদিকে অনুকূল বাতই প্রবাহিত হইয়াছিল,—
স্ত্রীপুত্রাদিকথাং জহুর্বিষয়িনঃ শাস্ত্রপ্রবাদং বুধাঃ যোগীন্দ্রা বিজহুর্মরুন্নিয়মজং ক্লেশং তপস্তাপসাঃ। জ্ঞানাভ্যাস-বিধিং জহুশ্চ যতয়শ্চৈতন্যচন্দ্রে পর- মাবিকুব্বতি ভক্তিযোগপদবীং নৈবান্য আসীদ্রসঃ ॥















Comments